![]() |
[বন্ধু অহীদকে নিয়ে লেখা] |
করোনার পরের কথা। সুলতান নামে আমাদের একজন স্যার ছিলেন। পুরো বিদ্যালয়ের ছাত্ররা উনাকে ভয় পেতো। একবার প্রবন্ধ লেখার প্রতিযোগিতা হলে— আমি প্রথম হই। হাতের লেখাও ভালো ছিলো; প্রবন্ধের ভাষাও সাবলীল ও মার্জিত ছিলো বিধায় তখন থেকেই সুলতান স্যারের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠি। স্যারকে সকলে ভয় পেলেও আমি মোটেও ভয় পেতাম না। আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো ও আদর করতো। মিষ্টি করে ডাকতো আমায়।
****
১৫ নভেম্বর ২০২১
কোভিড ১৯ এর শেষের দিকে। সেদিন রোববার ছিলো। তৃতীয় ঘন্টার বেল দিয়েছে। আমি ক্লাসে ছিলাম। ক্লাস শুরুর ২০ মিনিট বাকি আছে। হোমওয়ার্কগুলো দেখছিলাম। রাকিব ক্লাসে ঢুকতে-ঢুকতে বললো, আহমাদ আযীয! সুলতান স্যার তোকে ডাকছে। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম— আসছি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুবায়ের(বরিশাল) উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের ডাকবে না শুধু আযীযকেই ডাকবে। তরিক তার কথা টেনে নিয়ে— আরে... গতকাল তো খোদ জিএম স্যারও অফিসে ডেকেছিলো। হেলাল(মাদারীপুর) তার প্রতিত্তোরে বললো, আহমাদ ভাইকে সেদিন সুলতান স্যার নিজ গাড়ীতে করে কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছিলো। এবার শফিক(শরীয়তপুর) সুর মিলিয়ে বললো, সেদিন মাইজপাড়া জুনিয়র স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারও ডাকছিলো। আমি তাদের কথাগুলো শুনেই যাচ্ছি; আর খাতাগুলো দেখছি। বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু প্রতিত্তোর করছি না। এবার আমাদের ক্লাস মনিটর আশিক ভাই(কুষ্টিয়া) শফিকের দিকে তাকিয়ে বললো, কেন! আপনারা আহমাদ আযীযের মতো হতে পারেন না? ও কি আপনাদের মতো মানুষ না? সারাদিন তো আপনাদের মতো ফোন টিপে না। গল্পগুজবেও মাতে না!
সবাই চুপ হয়ে গেলো। আমি তো অবাক! আরাফাতা আমাকে খোঁচা দিয়ে হাসিমুখে বললো, তুই এ-তো ভালো কবে হলি রে...
আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না! আশিক ভাই(খোদ ক্লাস মনিটর) প্রকাশ্যে সবার সামনে আমার তা'রিফ করছে! যোবায়ের ও তরিক বেশ খুশি হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। যোবায়ের মুচকি হেসে বলছে, দোস্ত! তুই আজ মিষ্টি খাওয়াবি। মাহদী বললো, দেখ আযদীয সবাই তোরে নিয়ে নাক গলায়।
ইতিমধ্যে অহীদ(ফরিদপুর) কালো চেহারা। জট ভ্রু। লম্বা একটা নাক। বড়বড় চোখ। দেখলেই ভয় লাগে। রাগি-রাগি খিটখিটে মেজায। একটুতেই রেগে যায়। কারো সাথেই মিশতে পারে না। পড়াশোনাতেও কাঁচা। সন্ত্রাসী টাইপের।
—বাহির থেকে ক্লাসে ঢুকেই বলতেছে, আহমাদ! সুলতান স্যার ডাকছে তোকে। “হুম আসছি" বলে খাতাগুলো ভাজ করতে লাগলাম। এবার সে আমার কাছে এসে আমার কান দু’টো টানতেছে। আমি কোন রিয়্যাক্ট না করে খাতাগুলো দ্রুত গোছাতে লাগলাম। এরপর সে আমার মাথায় আঘাত করছে আর বলছে— সুলতান স্যার ডাকে। সুলতান স্যার ডাকে। আমি খাতাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে, তাকে সরিয়ে বের হয়ে যাবো তো সে আমাকে খেলার ছলে ডানে-বামে থাপড়াতে লাগলো... আমার যেন সহ্য হচ্ছে না! যখনই তাকে সড়িয়ে দিতে যাবো অমনি সে আমাকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, শুনিস্ না সুলতান স্যার ডাকে! আমার চশমাটা চারপাঁচ হাত দূরে ছিটকে পরে ভেঙে যায়। মাটিতে গড়িয়ে পরি আমি। বাকিটা কিছুই বলতে পারি না।
খানিক সময় পর....
চোখ মেলে দেখি— আমি ক্লিনিকের বেডে। আমার নাকে ও মাথায় পট্টি বাঁধানো। সুলতান স্যার, ইদ্রিস হুজুর ও বেলায়েত স্যার আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে। সুলতান স্যার জিজ্ঞেস করলো, আহমাদ ঠিক আছো তো তুমি? কেমন লাগছে তোমায়? সবাই যেন বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বেলায়েত স্যার বামপাশে দাঁড়িয়ে। সেদিকে তাকাতেই বললো, আযীয! কেমন লাগছে তোমায়? কষ্ট হচ্ছে না-তো! মাথাটা যেন ভাড় হয়ে আছে। নাকটা যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে থেঁতলে গেছে! মুখফুটে কিছুই বলতে পারছি না। স্যাররা চলে যাওয়ামাত্রই আশিক ভাই, তরিক, যোবায়ের, বেলাল ও আমি হামজা ভাই এসে ভীড় জমালো সেখানে...
*****
পুরো একদিন একরাত ক্লিনিকে কাটালাম। ম্যাচে এসে দেখলাম, চমার জামাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। চশমাটা চুরমার হয়ে গেছে। মুঠোফোনটাতে কয়েক ডজন কল ও মেসেজ জমে আছে। পরদিনে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই— যোবায়ের, হেলাল ও ইকবাল ছুটে আসে। ক্লাসে ঢোকামাত্র সবাই আমার কাছে ছুটে আসে। ঘিড়ে নেয় আমাকে। সবার সাথে কুশলাদির পর দেখলাম, আব্দুল অহীদ সবার পিছনে মনমরা হয়ে কি যেন লিখতেছে। আমি তার কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। মুচকি হেঁসে তার হাতটা ধরে বললাম, কি রে বন্ধু! মন খারাপ করে আছিস্ যে! দেখ্, আমি সেড়ে উঠেছি! তুই ভালো আছিস্ তো!
অহীদের মুখে কোন কথা নেই। অপলকনেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে একথোকা কৃতজ্ঞ খেলা করছে। আমি পিছনে তাকালাম। দেখি, গ্যালারীর দর্শকের মতো— সকলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে আছে ক্লাসরুমটা।
আমি অহীদের দু'হাত চেপে ধরে বললাম,
বেশ অভিমান করেছিস্ আমার উপর তা-ই না! তোর উপর আমার কোন অভিযোগ নেই বন্ধু! মন খারাপ করিস্ না তুই!
সে হিম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।
অহীদ কিছু বলতে যাবে হয়তো, এমন সময় সুলতান স্যার এসে ঢুকে পরলো ক্লাসে। একদিকে সবাই; আরেকদিকে আমি ও অহীদ। স্যার দেখে বললো, কি করছিলে এতোক্ষণে? আশিক ভাই সবকিছু বলে দিলো। স্যার অহীদকে অনেক বকাঝকা, শাষণ ও লজ্জিত করলো। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। কিছু বলতে যেয়েও বলিনি। স্যার আমাকে বললো, আহমাদ! ঠিক আছো তো! আলহামদুলিল্লাহ স্যার। আমি সুস্থ। সবশুনে স্যার বললো, আহমাদ আযীয! সে-তো সম্পর্ক গড়াতে পারে। ভাঙতে পারে না। তার আচার-আচরণে অনন্যতা প্রকাশ পায়.(...)
আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্যারের মুখে এমনটা শুনবো, কল্পনাও করিনি। সেদিন আর ক্লাস হয় নি। ঘন্টাগুলো এভাবেই কেটে গেলো।
*****
পরদিন আমরা ক্লাসে আসার পূর্বেই দেখি, অহীদ ৩ কেজি মিষ্টি নিয়ে এসেছে। সর্বপ্রথম সে তার নিজ হাতেই আমাকে মিষ্টিমুখ করায় ও স্যারসহ সকলের মাঝেই তা বিতরণ করেন। অতঃপর সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে— ৩০ সেকেন্ডের মতো কাঁদে। এরপর পিছনের সব দোষগুলো স্বীকার করে সবার সামনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেদিন পুরো ক্লাসে কি যে আনন্দ ছড়িয়েছিলো! সেদিনের বিবরণ শুধু বলার মতো—লিখার মতো নয়। পরেরদিনগুলোতে অহীদ পুরোই পরিবর্তন ও সকলের থেকে আলাদা। সকলের নজরে সে ভালো। ক্লাসেও ভালো ছাত্র হয়ে উঠলো। ম্যাচ চেঞ্জ করে চলে আসে আমার কাছে। প্রিয় বন্ধু হিসেবে আমাকে সকলের কাছে পরিচয় দেয়।সে-ও ধীরে-ধীরে..
[Ahmed Aziz 's Diary ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন