তখন আমি প্রাথমিক শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। পাচঁ ভাইবোনের মাঝে সকলের ছোট্ট ছিলাম। তাই মা-বাবার ভালোবাসাগুলো সবার উপর দিয়ে আমার মাথায় এসে পরতো। তখন বড়জোড় চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। মা আমাকে রোজা রাখতে দিতেন না। সাহরীতেও ডাকতেন না। সকালে ঘুম ভাঙার পর ভীষণ অভিমানে, গোমড়ামুখে বসে থাকতাম। অনেকটা জেদি হয়ে যেতাম। 'মা' সাহরীর খাবার শেষরাতেই রান্না করতেন। মজার মজার খাবার রান্না হতো সাহরীতে। নিজেকে সবসময় 'বড়' দাবী করতাম। ছোটবেলায় নিজেকে 'ছোটো' হিসেবে মেনে নিতে পারতাম না। ছোটআপু রোজা রাখতো। তাই ছোটআপুর সাথে নিজেকে তুলনা করে মাকে বকতাম। তখন 'মা' আমাকে 'রোজাদার' হিসেবে মেনে নিতেন। বড্ড খুশী হতাম। সকাল থেকে কিছুই খেতাম না। খেলাধুলা, বা স্কুল থেকে ফিরে এসে- সকাল গড়িয়ে যখন দুপুর আর সূর্যটা যখন ঠিক মাথার উপরে, পিপাসায় কাতর হয়ে যেতাম। তৃষ্ণায় ছাতিফাঁটার উপক্রম। নিস্তেজ হয়ে বসে পরতাম বারান্দায়। শরীর যেন ভেঙে পরে যেতো। কথাবলার শক্তিটাও যেন ক্ষয়ে যেতো। মা অস্থির হয়ে উঠতেন। 'সন্ধেবেলার ইফতার' আমার জন্য দুপুরেই তৈরী করতো আর বলতো, ছোটদের ইফতার দুপুরের আজানের সাথেই করতে হয়। ছোটআপু হাসাহাসি করতো। তাই দেখে গা জ্বলতো। ভীষণ রাগ হতো। মা তখন ছোটআপুকে ইঙ্গিতে কি যেন বলতো, বুঝতাম না। বড়আপু চুপিসারে ঘরে ডেকে এনে, পানি ও শরবত বানিয়ে দিয়ে বলতো, রোজায় এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলে রোজা নষ্ট হয় না। মেজোআপুও এমন বলতো তাই ঝটপট খেয়ে নিতাম! যোহরের আজান হলে, নামাজে ছুটে যেতাম। নামাজ শেষে, বাসায় এসে আপুর সাথে ঘুমিয়ে পড়তাম। ইফতারের পূর্বে মস্তবড় মিসওয়াক নিয়ে দাঁত মাজতাম; তা দেখে ছোটআপু অনেক হাসতো। ভীষণ ঝগড়া বিঁধে দিতাম। বড়আপু ও মা'কে এ নিয়ে নালিশ দিয়ে পৃথক হয়ে যেতাম। মা-বাবা, ভাইয়া ও আপুদের মিলে অনেক বড় ইফতারের আয়োজন হতো আমাদের। আমি সবার আগেই বসে পরতাম ইফতারে। পিয়াজি, বেগুনি, চপ, ছোলাবুট, খোরমা খেজুর, রুহ আফজা শরবতসহ রকমারি বিভিন্ন খাবারে সজ্জিত হতো ইফতারের প্লেট। মা প্রতিটি খাবারই আগে আমাকে দিতেন। শরবতের গ্লাসগুলো আমি আমার সামনেই রাখতাম; তা নিয়ে ছোটআপুর সাথে ভীষণ ঝগড়া হতো। ভাইয়া শেষমেশ আপুকে থামিয়ে আমাকেই দিয়ে দিতো। তখন বড্ড ভালো লাগতো। আমাদের মাসজিদে খতম তারাবীহ্ হতো। বাবা ও ভাইয়ার সাথে তারাবীতে যেতাম। বাবা সর্বদা সামনের কাতারে তারাবীহ্ পড়তেন। আমাকে সাথে নিয়েই সামনের কাতারে যেতেন। প্রথম কয়েকরাকাত বাবার সাথে, বেশ মনোযোগে পড়তাম। ১০/১২ রাকাত পড়ার পর বাবাকে না জানিয়েই, কাতার ভেঙে মসজিদের বারান্দায় চলে আসতাম। পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের আড্ডায় মজে উঠতাম। তারাবীহ্ শেষে -নামাজের গুরুত্ব বোঝাতে বোঝাতে বাবা বাড়িতে নিয়ে আসতেন।আজ আমি উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছি। ৮টি বছর কেটে যাচ্ছে মা-বাবা, ভাইয়া আর আপুদের সাথে ইফতার করতে পারিনা। ছোটবেলার মতো আজকালের ইফতারের প্লেট এতোটা মজাদার হয় না। শরবতের গ্লাস নিয়ে ঝগড়াও হয় না। তারাবীতে ক্লান্তি লাগে না। সাহরীতেও ঘুম আসে না; তবে মাঝে মাঝে ভীষণ হাসি পায়-অট্টহাসিতে ফেটে পরি, পরক্ষণেই অশ্রুতে ভরে উঠে আখিঁ- "বড়আপুর চুপিসারে খাবার দেওয়া, যোহরের আজানে মায়ের ইফতার খাওয়ানো, ছোটআপুর সাথে খুনসুঁটি, ইফতারিতে ভাইয়ার বিচার, বাবার সাথে তারাবীতে যাওয়া আর সাহরীতে ডেকে না দিলে সেই অভিমানী দিনগুলো" আবার কি ফিরে পাবো কখনো!
ছোটবেলার রোজা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
ফুটপাতে শুয়ে থাকা লোকটাও মানুষ। সুতরাং তাকে দেখে নাক ছিটকাবেন না।
স্মৃতিগুলো আজ মনের গহীনে লুকিয়ে আছে...
শৈশবের সেই নির্মল আনন্দ, কৈশোরের দুরন্তপনা, আর তারুণ্যের দুঃসাহসী স্বপ্ন—সব মিলিয়ে এক মায়াবি জগতের মধ্য দিয়ে এসেছি। কত আশা, কত স্বপ্ন, কত অভ...

জনপ্রিয়গুলো দেখুন
-
নিস্তব্ধ গ্রামের রাত্রী। ঝিঁঝি পোকার শব্দে নির্জন পুকুরপাড়টা সচকিত হয়ে উঠেছে। আকাশে একফালি চাঁদ হেঁসে উঠেছে। দূরপল্লী থেকে কুকুরের ঘেউঘেউ ...
-
রাস্তার সস্তা জীবন যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ধুলোর স্তুপে একব্যক্তিকে ঘুমন্ত দেখে— হাঁটি হাঁটি পায়ে লোকটার কছে আসলাম। গভীর ঘুমে...
-
তখন আমি প্রাথমিক শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। পাচঁ ভাইবোনের মাঝে সকলের ছোট্ট ছিলাম। তাই মা-বাবার ভালোবাসাগুলো সবার উপর দিয়ে আমার মাথায় এসে পরতো। তখ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন