ভালোলাগার ভালোলাগা



 ঝুম বৃষ্টি, কি যে মিষ্টি! 

এশার নামাজপড়ে বেলকনিতে গেলাম। খুব গরম লাগতেছে। চারতলা থেকে নিচের দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম। আরে, রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা জল কেন! ডানে-বামে তাকলাম, পুরো রাস্তা ফাঁকা। দু'একটা প্রাইভেট কার আসছে তো- দ্রুত ছুটছে। পিচঢালা রাস্তায় পানির ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে। আকাশের দিকে তাকাতেই হৃদয়ে ঢেউ খেয়ে গেলো। এ-যে বৃষ্টি নামতেছে! লোহার গ্রিলের ভিতর দিয়ে হাতদুটো বাহিরে বাড়িয়ে দিলাম। মুক্তোসম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, হাতদুটো চুমতে লাগলো। হিমশীতল বৃষ্টির ফোঁটার ছোঁয়ায়, বদনে কি-এক অনুভূতি সৃষ্টি হলো। একেক বৃষ্টির ফোঁটায়, হাতের লোমগুলো শরীরের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। অপলক তাকিয়ে আছি আমি। হাতকে ছুঁয়ে দেয়া প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা, যেন হৃদয়কে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঝুম বৃষ্টির ছোঁয়ায়, বড়বড় বিল্ডিংগুলো চিকচিক করছে। মনে হয়, তারাও আমার মতো পুলকিত। নিচে তাকিয়ে দেখি, ছাতামাথায় একজন হেঁটে যাচ্ছে। দুতলার মাথা ছুঁয়েছে— নিমগাছটার পাতাগুলো বৃষ্টির ফোঁটায় আলতো দুলছে। সেই সাথে, জ্বলজ্বল করে উঠেছে। পার্শ্বের বিল্ডিং-এর দেয়াল বেয়েপড়া, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, বাতির আলোয় খশেপড়া তারার মতো ছুটছে। পশ্চিমাকাশে— থেকে থেকে ঈষৎ বিজলী চমকাচ্ছে। সবমিলিয়ে চারদিকের পরিবেশকে, খুব মায়াময় লাগছে। ফুলের টবগুলোতে যেন, থোকা-থোকা ভালোলাগা ফলেছে!


আস্তিক

 আমরা দুঃখ-কষ্টের উদরে জন্ম নেয়া মানব সন্তান। তোমরা সুখসাচ্ছন্দ্যের ছায়াতলে বেড়েওঠা মানুষ্যপুত্র। দুঃখ-কষ্ট আর যাতনা আমাদের মাতৃকোল। কষ্ট তো ঈশ্বরের ছায়া; মৃত্যু হৃদয়ের চারণভূমিতে যা চাষ করা যায় না। আমরা বেদনাকাতর আত্মা নিয়ে বেড়েওঠি; আর বেদনা তো অনেক ভাড়ী পদার্থ। ক্ষুদ্র হৃদপিণ্ড যার ভারত্ব বহন করতে পারে না। আমরা অনবরত চোখ দিয়ে রক্ত ঝরাই। চিৎকার করে বিলাপ করি। আমাদের অশ্রুজলে যারা একবার স্নান করবে— আজন্ম শুদ্ধতার পরশ অনুভব করবে। তোমরা আমাদের ইতিকথা, পরিচয়-পরিচিতি জানো না। তবে আমরা তোমাদের চিনি। তোমরা তো জীবনচক্রের নদীতে দ্রুতই আবর্তিত হও। পিছন ফিরে একবারও তাকাও না— আমরা কোথায়। নদীর কূলে বসে আমরা তোমাদের দেখতে পাই। শুনি তোমাদের হৃদয়ের ফিসফিসানী। তোমরা ভ্রুক্ষেপ করো না আমাদের আত্ম চিৎকারের প্রতি; কারণ কালের ড্রেজারের আওয়াজ ভরে দিয়েছে তোমাদের কর্ণকুহর। আমরা শুনি অবেলায় তোমাদের গান। নিঃসীম রজনীর স্পষ্ট সুর লহরি উজার করে দিয়েছে আমাদের কর্ণ দেয়াল। আমরা তোমাদের দেখি। তোমরা দাঁড়িয়ে আছো অন্ধকারাচ্ছন্ন নিবিড় কুহেলিকায়। আমরা বাসকরি আলো ঝলমলে আঁধারের পৃথিবীতে। তোমরা আমাদের দেখবে কি করে! আমরা দুঃখিনী মায়ের সন্তান। আমরা আম্বিয়া। আমরা উন্মাদ করি। কালের গিটারে মিউজিক বাজিয়ে চলি সারাকাল। আমরা আপন হৃদয়ের সুতোয় গেঁথে চলি ঈশ্বরের জামা। হৃদয়ের বুনোফুল দিয়ে ভরে দেই ফেরেশতাদের অঞ্জলি। তোমরা তো আনন্দ-উল্লাসে, উদাসীনতার বুক চিরে জন্মানো— জাগ্রত ভোগের প্রভু! নিজেদের বুক ফেঁড়ে, হৃদপিণ্ড বের করে, মেলে ধরো নির্জনতার কাছে। কারণ নির্জনা প্রেমিকার হাত বড় কোমল! অজ্ঞতার দীক্ষা নিয়ে আনন্দকে খুঁজে বেড়াও। অজ্ঞতার তাজমহল তো আয়না থেকে শূন্য। কীভাবে দেখবে নিজেদের শুঁয়ো মুখো চেহারা!

আক্ষেপ



 আচ্ছা, মানুষের জীবন এমন কেন? আঁকাবাঁকা! বেদনাবিধুর! বিষাদময়! রেললাইনের মতো সমান্তরাল ধারায় কি জীবন চলতে পারে না? যদি এমন হতো- মানুষের জীবনে কোন দুঃখই থাকতো না। থাকতো শুধু Low-income, আরাম ও আয়েশ।

ফেলা আসা দিনগুলো

 


 জামতলীর দিনগুলো... 

 গ্রামে ফারুক নামে আমার এক প্রতিবেশী আছে। কৈশোরের দিনগুলোর বড় একটা অংশ তার সাথেই কেটেছে। চৈত্রী দুপুরে- ছাতিফাটা রোদে মাঠ-ঘাট যখন খাঁ খাঁ করতো— মা আমাকে বিছানায় নিয়ে ঘুমপাড়ানি গানে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। আমিও চক্ষুবুজে চুপকরে থাকতাম। মায়ের হাতটা যখন থেমে যেতো, চোখমেলে দেখতাম- মা ঘুমিয়ে পড়েছে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসতাম। এসে দেখতাম ঘরের পিছনে সজীব, মীম ও নাঈমসহ ফারুক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারাও ঘুমফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছে। ফারুকের নেতৃত্বে ধানক্ষেত পেরিয়ে ছুটে যেতাম খাঁ-দের খেজুর বাগানে— সেখানে বড়সড় একটা জামগাছ আছে। ধানক্ষেতের ভেপসা গরম, মাথার উপর কাঠফাটা রোদ এরমাঝে আলপথে হেঁটে চলা! টসটসে লাল হয়ে যেতাম। কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরতো। জামের নেশায় তখন এসব কিছুই মনে হতো না। জামতলীতে এসেই ধপ্ করে বসে পরতাম। আর ফারুক কয়েক লাফেই জামগাছের মাথায় উঠে যেতো। যেকোনো গাছ বাইতে বড্ডপটু সে! তারপর উঠতো— নাঈম, সজীব ও মীম। সবার শেষে উঠতাম আমি। ফারুক, নাঈম আর সজীব গাছের মগডাল থেকে থোকা থোকা জাম নিয়ে আসতো। মীম ও আমি সেগুলো জমা করতাম। সাথে নিয়ে যাওয়া পলিথিন ভরে গেলে, ফারুক ও নাঈম জামগুলো নিয়ে আগে নেমে যেতো। তারপর আমরা নেমে আসতাম। জামতলীতে বসে জামগুলো সমানভাবে ভাগ করতাম। কেউ কোন অংশে কমবেশি করতাম না। তারপর প্রাপ্ত জামগুলো কলাপাতা কিংবা কচুপাতায় মুড়িয়ে নিয়ে আলপথে ছুটে যেতাম পাকুড়তলীতে। পাকুড়ের শিকড়ে বসে বসে জাম খেতাম আর পা-গুলো ঝুলিয়ে দিতাম পুকুরের পানিতে! পাকুড়গাছে পাখিদের হৈচৈ, পানিতে রোদের কিরণ, আর স্নিগ্ধ বাতাসে কাঁচা ধানের মৌ মৌ গন্ধ ভেষে আসতো! আহ, কী-যে ভালো লাগত!! রূপকথার নানান গল্পে মেতে যেতাম আর জামের বিচি দিয়ে পানিতে ঢিলছুড়ার প্রতিযোগিতা করতাম। এভাবেই কেটে যেতো গ্রীষ্মের দুপুর...

হতাশা

 


মানুষের জীবনে সবচে’ বেদনাদায়ক বিষয় হলো 'হতাশা'। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজেকে বড় অসহায়বোধ করে। বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসে না। আত্মবিশ্বাসী কেউ থাকে না। তবুও সে অনেক ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হতে চায়। জীবন সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে চায়। এমনকি কিছু পথ এগিয়েও যায়। কিন্তু গুলি খাওয়া পাখির ন্যায় উড়তে চেয়েও উড়ে যেতে পারে না। বহু চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়। এক সময় সে ভেঙেপড়ে হতাশায়। আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। 

মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে বড় বেশী ব্যস্ত। কাউকে সময় দিতে চায় না। কারো সঙ্গী হতে চায় না। কারো সঙ্গ দিতে চায় না। 

এই জীবনে যারা হতাশাগ্রস্ত তাদের আমি ভালোবাসি। তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। তাদের সান্ত্বনার বাণী শোনাতে চাই।

আমিও হতাশায় দগ্ধ হয়েছিলাম। বহু ঝড়-ঝাপটা ও বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন আমিও কামনা করেছিলাম, কোন দরদী বন্ধু এসে আমাকে সান্ত্বনা দিবে আর বলবে—

ভয় কিসের বন্ধু? আমি আছি তোমার পাশে...

মৃত্যু



মৃত্যু একটি মহা দুর্ঘটনা। যা সহজ হয়ে গেছে এবং এমন এক কঠিন ছোঁয়া— যা সহনীয় হয়ে গেছে। দুনিয়ার কর্মকাণ্ড এমন দুঃসহ হয়ে পড়েছে- যারফলে মৃত্যু হয়েছে তার অতি হালকা দুর্ঘটনা। দুনিয়া এমন সব অপরাধ সংঘটিত করেছে যে, মৃত্যু হলো তার অতি ছোট্ট অপরাধ! তুমি তোমার ডানদিকে তাকিয়ে দেখো—কেবল কষ্টছাড়া কিছুই নেই। বামদিকে তকিয়ে দেখো— কেবল আক্ষেপছাড়া কিছুই নেই।



বেঁচে থাকার সংগ্রাম

❝ একটু সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য মানুষের প্রচেষ্টার শেষ নেই। মানুষের জীবনে যতো ত্যাগ-তিতিক্ষা, দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও সহনশীলতা সবই কেবল বেঁচে থাকার জন্য। সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করার জন্য মানুষের কতোই না সংগ্রাম!  ❞

ফ্লাইওভারের নীচে


     রাস্তার সস্তা জীবন

 যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ধুলোর স্তুপে একব্যক্তিকে ঘুমন্ত দেখে— হাঁটি হাঁটি পায়ে লোকটার কছে আসলাম। গভীর ঘুমে ডুবে আছে। ধুলোমলিন ঝাঁকড়া চুল। কয়েকটা জটবেঁধে আছে। ধুলোয় মিশ্রিত ফুলপ্যান্ট পরিহিত। বেল্ট হিসেবে কোমরে একটা রশি বেঁধে নিয়েছে। লাল হাফহাতা গেঞ্জি পরেছে; সেটাও ধুলোবালির মিশ্রণে সেটাও খয়েরী হয়েছে। আমি আরও কাছে এলাম। এক্কেবারে কাছে এলাম। হালকা কৃষ্ণবরণ অবয়ব। দাঁড়ি আর গোঁফে চেহারাটা ঢেকে আছে। চেহারায় পাগলামি ও মাতলামির কোন ছাপ নেই। আশেপাশে কোন পুটলিও নেই। পঞ্চাশ, ষাট গজ বামে ময়লার স্তুপ। গাড়ীর বাতাসের ঝাপটায় দুর্গন্ধ ভেষে আসছে। ডানদিকেও একই অবস্থা। এর মাঝেও লোকটা বেশ আরামে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘামঝরা পরিশ্রম করে, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে শুয়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ব্যস্ত শড়কের যান্ত্রিক কোলাহলে, জীবনের অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতেও ঘুম কিভাবে এতোটা গভীর হয়!

Ahmed's Diary থেকে সংগ্রহীত

বারো/নয়/বাইশ

আজও মনেপড়ে...

[বন্ধু অহীদকে নিয়ে লেখা]


 করোনার পরের কথা। সুলতান নামে আমাদের একজন স্যার ছিলেন। পুরো বিদ্যালয়ের ছাত্ররা উনাকে ভয় পেতো। একবার প্রবন্ধ লেখার প্রতিযোগিতা হলে— আমি প্রথম হই। হাতের লেখাও ভালো ছিলো; প্রবন্ধের ভাষাও সাবলীল ও মার্জিত ছিলো বিধায় তখন থেকেই সুলতান স্যারের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠি। স্যারকে সকলে ভয় পেলেও আমি মোটেও ভয় পেতাম না। আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো ও আদর করতো। মিষ্টি করে ডাকতো আমায়।


****


১৫ নভেম্বর ২০২১

কোভিড ১৯ এর শেষের দিকে। সেদিন রোববার ছিলো। তৃতীয় ঘন্টার বেল দিয়েছে। আমি ক্লাসে ছিলাম। ক্লাস শুরুর ২০ মিনিট বাকি আছে। হোমওয়ার্কগুলো দেখছিলাম। রাকিব ক্লাসে ঢুকতে-ঢুকতে বললো, আহমাদ আযীয! সুলতান স্যার তোকে ডাকছে। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম— আসছি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুবায়ের(বরিশাল) উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের ডাকবে না শুধু আযীযকেই ডাকবে। তরিক তার কথা টেনে নিয়ে— আরে... গতকাল তো খোদ জিএম স্যারও অফিসে ডেকেছিলো। হেলাল(মাদারীপুর) তার প্রতিত্তোরে বললো, আহমাদ ভাইকে সেদিন সুলতান স্যার নিজ গাড়ীতে করে কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছিলো। এবার শফিক(শরীয়তপুর) সুর মিলিয়ে বললো, সেদিন মাইজপাড়া জুনিয়র স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারও ডাকছিলো। আমি তাদের কথাগুলো শুনেই যাচ্ছি; আর খাতাগুলো দেখছি। বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু প্রতিত্তোর করছি না। এবার আমাদের ক্লাস মনিটর আশিক ভাই(কুষ্টিয়া) শফিকের দিকে তাকিয়ে বললো, কেন! আপনারা আহমাদ আযীযের মতো হতে পারেন না? ও কি আপনাদের মতো মানুষ না? সারাদিন তো আপনাদের মতো ফোন টিপে না। গল্পগুজবেও মাতে না!

সবাই চুপ হয়ে গেলো। আমি তো অবাক! আরাফাতা আমাকে খোঁচা দিয়ে হাসিমুখে বললো, তুই এ-তো ভালো কবে হলি রে...

আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না! আশিক ভাই(খোদ ক্লাস মনিটর) প্রকাশ্যে সবার সামনে আমার তা'রিফ করছে! যোবায়ের ও তরিক বেশ খুশি হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। যোবায়ের মুচকি হেসে বলছে, দোস্ত! তুই আজ মিষ্টি খাওয়াবি। মাহদী বললো, দেখ আযদীয সবাই তোরে নিয়ে নাক গলায়।

ইতিমধ্যে অহীদ(ফরিদপুর) কালো চেহারা। জট ভ্রু। লম্বা একটা নাক। বড়বড় চোখ। দেখলেই ভয় লাগে। রাগি-রাগি খিটখিটে মেজায। একটুতেই রেগে যায়।  কারো সাথেই মিশতে পারে না। পড়াশোনাতেও কাঁচা। সন্ত্রাসী টাইপের। 

—বাহির থেকে ক্লাসে ঢুকেই বলতেছে, আহমাদ! সুলতান স্যার ডাকছে তোকে। “হুম আসছি" বলে খাতাগুলো ভাজ করতে লাগলাম। এবার সে আমার কাছে এসে আমার কান দু’টো টানতেছে। আমি কোন রিয়্যাক্ট না করে খাতাগুলো দ্রুত গোছাতে লাগলাম। এরপর সে আমার মাথায় আঘাত করছে আর বলছে— সুলতান স্যার ডাকে। সুলতান স্যার ডাকে। আমি খাতাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে, তাকে সরিয়ে বের হয়ে যাবো তো সে আমাকে খেলার ছলে ডানে-বামে থাপড়াতে লাগলো... আমার যেন সহ্য হচ্ছে না! যখনই তাকে সড়িয়ে দিতে যাবো অমনি সে আমাকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, শুনিস্ না সুলতান স্যার ডাকে! আমার চশমাটা চারপাঁচ হাত দূরে ছিটকে পরে ভেঙে যায়।  মাটিতে গড়িয়ে পরি আমি। বাকিটা কিছুই বলতে পারি না।

খানিক সময় পর....

চোখ মেলে দেখি— আমি ক্লিনিকের বেডে। আমার নাকে ও মাথায় পট্টি বাঁধানো। সুলতান স্যার, ইদ্রিস হুজুর ও বেলায়েত স্যার আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে। সুলতান স্যার জিজ্ঞেস করলো, আহমাদ ঠিক আছো তো তুমি? কেমন লাগছে তোমায়? সবাই যেন বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বেলায়েত স্যার বামপাশে দাঁড়িয়ে। সেদিকে তাকাতেই বললো, আযীয! কেমন লাগছে তোমায়? কষ্ট হচ্ছে না-তো! মাথাটা যেন ভাড় হয়ে আছে। নাকটা যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে থেঁতলে গেছে! মুখফুটে কিছুই বলতে পারছি না। স্যাররা চলে যাওয়ামাত্রই আশিক ভাই, তরিক, যোবায়ের, বেলাল ও আমি হামজা ভাই এসে ভীড় জমালো সেখানে...


*****


পুরো একদিন একরাত ক্লিনিকে কাটালাম। ম্যাচে এসে দেখলাম, চমার জামাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। চশমাটা চুরমার হয়ে গেছে। মুঠোফোনটাতে কয়েক ডজন কল ও মেসেজ জমে আছে। পরদিনে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই— যোবায়ের, হেলাল ও ইকবাল ছুটে আসে। ক্লাসে ঢোকামাত্র সবাই আমার কাছে ছুটে আসে। ঘিড়ে নেয় আমাকে। সবার সাথে কুশলাদির পর দেখলাম, আব্দুল অহীদ সবার পিছনে মনমরা হয়ে কি যেন লিখতেছে। আমি তার কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। মুচকি হেঁসে তার হাতটা ধরে বললাম, কি রে বন্ধু! মন খারাপ করে আছিস্ যে! দেখ্, আমি সেড়ে উঠেছি! তুই ভালো আছিস্ তো! 

অহীদের মুখে কোন কথা নেই। অপলকনেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে একথোকা কৃতজ্ঞ খেলা করছে। আমি পিছনে তাকালাম। দেখি, গ্যালারীর দর্শকের মতো— সকলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।  পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে আছে ক্লাসরুমটা।

আমি অহীদের দু'হাত চেপে ধরে বললাম, 

বেশ অভিমান করেছিস্ আমার উপর তা-ই না!  তোর উপর আমার কোন অভিযোগ নেই বন্ধু! মন খারাপ করিস্ না তুই!

সে হিম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

অহীদ কিছু বলতে যাবে হয়তো, এমন সময় সুলতান স্যার এসে ঢুকে পরলো ক্লাসে। একদিকে সবাই; আরেকদিকে আমি ও অহীদ। স্যার দেখে বললো, কি করছিলে এতোক্ষণে? আশিক ভাই সবকিছু বলে দিলো। স্যার অহীদকে অনেক বকাঝকা, শাষণ ও লজ্জিত করলো। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। কিছু বলতে যেয়েও বলিনি। স্যার আমাকে বললো, আহমাদ! ঠিক আছো তো! আলহামদুলিল্লাহ স্যার। আমি সুস্থ। সবশুনে স্যার বললো, আহমাদ আযীয!  সে-তো সম্পর্ক গড়াতে পারে। ভাঙতে পারে না। তার আচার-আচরণে অনন্যতা প্রকাশ পায়.(...)

আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।  স্যারের মুখে এমনটা শুনবো, কল্পনাও করিনি। সেদিন আর ক্লাস হয় নি। ঘন্টাগুলো এভাবেই কেটে গেলো। 


*****


পরদিন আমরা ক্লাসে আসার পূর্বেই দেখি, অহীদ ৩ কেজি মিষ্টি নিয়ে এসেছে। সর্বপ্রথম সে তার নিজ হাতেই আমাকে মিষ্টিমুখ করায় ও স্যারসহ সকলের মাঝেই তা বিতরণ করেন। অতঃপর সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে— ৩০ সেকেন্ডের মতো কাঁদে।  এরপর পিছনের সব দোষগুলো স্বীকার করে সবার সামনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেদিন পুরো ক্লাসে কি যে আনন্দ ছড়িয়েছিলো! সেদিনের বিবরণ শুধু বলার মতো—লিখার মতো নয়। পরেরদিনগুলোতে অহীদ পুরোই পরিবর্তন ও সকলের থেকে আলাদা। সকলের নজরে সে ভালো। ক্লাসেও ভালো ছাত্র হয়ে উঠলো। ম্যাচ চেঞ্জ করে চলে আসে আমার কাছে। প্রিয় বন্ধু হিসেবে আমাকে সকলের কাছে পরিচয় দেয়।সে-ও ধীরে-ধীরে..

[Ahmed Aziz 's Diary ]

আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্ট দেয়!

 



আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্ট দেয়?

এই বিষয়টা বোঝার জন্য দেখুনঃ সুরা_ইব্রাহীম-৩৪, সুরা_বনি_ইসরাইল-৬৭, সুরা_হজ্জ-৬৬, সুরা_ফুরকান-৫০, সুরা_আশ_শুরা-১৯, সুরা-আর-রুম-৫১, সুরা_সাবা-১৭, সুরা_আয_যুখ্রুফ-১৫, সুরা_আবাসা-১৭, সুরা_আদিয়াত-৬।


বিশ্বের প্রতি ৫ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন মানুষের লেখাপড়ার সুযোগ হয়। আপনার লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে তো?

বিশ্বের মাত্র ৭% মানুষের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ হয়। আপনার সেই সুযোগ হয়েছে তো?

বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি শিক্ষার্থী হাই স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। আপনি হাই স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেছেন তো?

বিশ্বের প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে অন্তত একটি শিশু প্রাইমারী স্কুল থেকে বঞ্চিত হয়। আপনি প্রাইমারী স্কুলে পড়েছেন তো?

সারা বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ নিরক্ষর। লিখতে পড়তে জানে না। আপনি আমার এই লেখাটা পড়তে পারছেন তো?

বিশ্বের ৪০% মানুষের ইন্টারনেট ব্যাবহার করার সামর্থ্য নেই। ১০%-১৫% মানুষ ইন্টারনেট জিনিসটা চেনেই না। আপনি ইন্টারনেট ব্যাবহার করেন তো?

আপনি যখন এই লেখাটা পড়ছেন তখন বিশ্বের প্রতি ৭ জনের মধ্যে অন্তত একজন মানুষ অভুক্ত (না খেয়ে আছে)। আপনি খেয়েছেন তো?

বাংলাদেশে প্রতি মিনিটে অন্তত একজন মারা যায়। আপনি যতক্ষণ ধরে এই লেখাটি পড়ছেন ততক্ষণে অন্তত ৩ (তিন) জন মারা গেছে। আপনি এখনো বেঁচে আছেন।

লেখার শুরুতে যে কয়েকটি আয়াতের নম্বর দিয়েছি, সেগুলো খুজে দেখেন নি, তাই না? ওই আয়াতগুলো পড়ে দেখুন। আর কিছু না বুঝলেও, ওই আয়াতগুলোর ভেতরে একটি কথা বুঝতে পারবেন - মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।

অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত!

 হে অতীত!

তুমি তো চলে গেছো এবং রবির মতো শেষ হয়ে গেছো। অতএব তোমার জন্য কাঁদব না। তুমি আমাকে তোমার আলোচনায় ব্যাপৃত দেখবে না; কেননা তুমি আমাকে ছেড়েছো। আমাকে পরিত্যাগ করেছো। আমাদের থেকে চলে গেছো। আর কখনও ফিরে আসবে না বলে।


হে ভবিষ্যৎ! 

তুমি অদৃশ্য—অস্পৃশ্য। অতএব আমি কল্পনার পিছু ছুটব না। কল্পনার জন্য নিজের অস্তিত্বকে বিকিয়ে দিব না। অস্তিত্বহীন বস্তুকে আবিষ্কারের জন্য তাড়াহুড়োও করব না; কেননা আগামীকাল তো তুমি সৃষ্টিই হও নি। তুমি আগেও ছিলে না। সুতরাং তোমার জন্য অস্থির হবো না। 


কেবল আজকেই!

আজকের জন্যই অন্যের উপকারার্থে বেঁচে থাকবো। আজকের জন্য অন্যের সাথে ভালো আচরণ করবো। আজকের জন্য হৃদয়ের গভীরে সম্মান ও ফজিলতের চারা রোপন করবো। লোভ, হিংসা, অহঙ্কার, ঘৃণা ও কুধরাণার বিষবৃক্ষকে মেরে ফেলবো। যারা নিজের জীবনকে সুন্দর ও জ্যোতির্ময় করতে চায়— তারা যেন মনে রাখে, জীবন অভিধানে এটিই সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন শব্দ— ‘আজকের দিনটিই তোমার দিন, তুমি এটির মূল্যায়ন করো।’


 

সবসময় মনে আসে আমি হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না, এটা থেকে পরিত্রাণ পাবো কিভাবে?

 

একজন আলেম, আফ্রিকার কোন একটি দেশে গিয়েছিলেন। সেখানে তার বিভিন্ন কাজের মধ্যে, একবার সংবাদ পেলেন - জেলখানায় গিয়ে উপদেশমূলক কিছু বলতে হবে। তিনি খুশিমনে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন, ফাঁসির আসামিকে উপদেশমূলক কিছু বলতে হবে। তিনি একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন - যে লোকটি কয়েকদিন পরে মরে যাবে, তাকে কি উপদেশ দিবেন !!


যখন ওই আসামীর সাথে দেখা হলো, তখন সেই আলেম বললেন - আলহামদুলিল্লাহ্‌। এই কথা শুনে, ওই আসামী, পুলিশ, সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তখন আলেম বললেন - আপনার গায়ে যে বিশেষ রঙের পোশাক রয়েছে, সেটা দেখে বোঝা যায় আপনি ফাসির আসামী, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনার মতন আমরা সবাই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদের গায়ে বিশেষ ধরনের পোশাক নেই বলে, বিষয়টা বোঝা যায় না। আপনি মৃত্যুর তারিখ জানেন বলেই, আপনার তওবার সুযোগ আছে। অন্যরা মৃত্যুর তারিখ না জানার জন্য, তওবা করার এত ভালো সুযোগ পায় না। এভাবে চিন্তা করলে, আপনি আসলে ভাগ্যবান।


সত্যিই আমরা বেশিদিন বাচবো না। আপনি ঠিকই চিন্তা করছেন। এই চিন্তা থেকে পরিত্রান চান কেন?

ওই আলেমের কথা শেষ। এবার আমার কথা শুরু। সহজ একটি হিসাব করুন। সারা বিশ্বে প্রায় ৭৭৫ কোটি মানুষ আছে। পরকালে, শেষ বিচারের দিন, সবাই যদি একসাথে লাইনে দাঁড়ায়, তাহলে আপনার সিরিয়াল আসতে কতদিন লাগবে? বিচার শেষে জান্নাত-জাহান্নাম তো অনেক পরে। বিচারের আগে লক্ষ বছর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেই লক্ষ বছরের তুলনায়, আপনার জীবনটা কতদিন?


সত্যিই আমরা বেশিদিন বাচবো না। আপনি ঠিকই চিন্তা করছেন। এই চিন্তা থেকে পরিত্রান চান কেন?

আফ্রিকার ফাসির আসামীর কথা শুনেছেন। এবার জাপানের আসামীর কথা শুনুন। মানসিক অস্থিরতায় রাখার জন্য, ইচ্ছা করেই জাপানের আসামীকে, ফাসির তারিখ জানানো হয় না। আসামী প্রতিদিন চিন্তা করে - আজকের দিনটিই তার শেষ দিন। বোঝা গেলো, অন্যান্য দেশের ফাঁসির আসামীর চেয়ে আরো বেশী অভাগা হলো জাপানের ফাঁসির আসামী।


আসলে, দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই তেমন অভাগা। কে, কবে, কোথায়, মরবে - সেটা কেউই জানে না। হতে পারে, আজকের দিনটিই আমার শেষ দিন। হতে পারে, আমি এই লেখাটা শেষ করার আগেই মরে যাবো। যে কোন মুহুর্তে মৃত্যু আসতে পারে।


সত্যিই আমরা বেশিদিন বাচবো না। আপনি ঠিকই চিন্তা করছেন। এই চিন্তা থেকে পরিত্রান চান কেন?

আমাদের অবস্থা ঠিক ওই জাপানের ফাঁসির আসামীর মতন। যে কোন মুহুর্তে মরতে পারি। মৃত্যু নিকটে, সেটা জানি। কিন্তু, মৃত্যুর তারিখ জানি না। তাই সর্বদা তওবা করে রাখা উচিত।


বোনাস:


হাশরের ময়দানে কতদিন লাইনে দাঁড়াতে হবে?

শৈশব-কৈশোর পেড়িয়ে

 

১৩-১৮ এবং ১৮-২৩ এই সময়গুলোকে স্বর্ণযুগ বলা যায়।  জীবনকে সাজানোর সকল উপকরণ এই সময়ের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে বিদ্যমান। এই বয়সগুলোর 'সঠিক পরিচর্যা' আর 'সাধ্যমতো পরিশ্রম' জীবনকে নিয়ে যায়- সম্ভাবনাময় এক সফল দিনের দিকে। জীবনের এই সুবর্ণ সময়গুলোর সঠিক পরিচর্যা করে, গ্রামের অজপাড়াগাঁয়েও ইতিহাস রচিত হয়েছে।
তারুণ্যের এই বয়সে মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে বিক্ষিপ্ত। আবেগ প্রাধান্য পায় বিবেকের উপর। যুবক-যুবতীরা তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ে। তারুণ্যের উদ্দীপনায় পৃথিবীতে তাকায় তৃতীয় আরেক জোড়া চোখে। ডুব দেয়- যান্ত্রিক আর আধুনিক জীবনের ভার্চুয়াল জগতে। বেলাশেষে, যার ফলাফল শূন্য এবং খেসারত— সময়, স্বাস্থ্য ও অর্থ!
অথচ সম্ভাবনাময় এই সময়গুলোর সঠিক মূল্যায়ন করে প্রভুর সান্নিধ্য, পার্থিব সাফল্য ও প্রকৃত মানুষ্যত্ব অর্জন করা সম্ভব।


একঝলক : 

মানুষের জীবনে ২০ বছর পর্যন্ত ইচ্ছার রাজত্ব চলে, ৩০ বছর পর্যন্ত চলে বুদ্ধির রাজত্ব আর ৪০ বছর বয়সে আসে বিচার-বিবেচনার রাজত্ব।



ছোটবেলার রোজা

 

তখন আমি প্রাথমিক শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। পাচঁ ভাইবোনের মাঝে সকলের ছোট্ট ছিলাম। তাই মা-বাবার ভালোবাসাগুলো সবার উপর দিয়ে আমার মাথায় এসে পরতো। তখন বড়জোড় চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। মা আমাকে রোজা রাখতে দিতেন না। সাহরীতেও ডাকতেন না। সকালে ঘুম ভাঙার পর ভীষণ  অভিমানে, গোমড়ামুখে বসে থাকতাম। অনেকটা জেদি হয়ে যেতাম। 'মা' সাহরীর খাবার শেষরাতেই রান্না করতেন। মজার মজার খাবার রান্না হতো সাহরীতে। নিজেকে সবসময় 'বড়' দাবী করতাম। ছোটবেলায় নিজেকে 'ছোটো' হিসেবে মেনে নিতে পারতাম না। ছোটআপু রোজা রাখতো। তাই ছোটআপুর সাথে নিজেকে তুলনা করে মাকে বকতাম। তখন 'মা' আমাকে  'রোজাদার' হিসেবে মেনে নিতেন। বড্ড খুশী হতাম। সকাল থেকে কিছুই খেতাম না। খেলাধুলা, বা স্কুল থেকে ফিরে এসে-  সকাল গড়িয়ে যখন দুপুর আর সূর্যটা যখন ঠিক মাথার উপরে, পিপাসায় কাতর হয়ে যেতাম। তৃষ্ণায় ছাতিফাঁটার উপক্রম। নিস্তেজ হয়ে বসে পরতাম বারান্দায়। শরীর যেন ভেঙে পরে যেতো। কথাবলার শক্তিটাও যেন ক্ষয়ে যেতো। মা অস্থির হয়ে উঠতেন। 'সন্ধেবেলার ইফতার' আমার জন্য দুপুরেই তৈরী করতো আর বলতো, ছোটদের ইফতার দুপুরের আজানের সাথেই করতে হয়। ছোটআপু হাসাহাসি করতো। তাই দেখে গা জ্বলতো। ভীষণ রাগ হতো। মা তখন ছোটআপুকে ইঙ্গিতে কি যেন বলতো, বুঝতাম না। বড়আপু  চুপিসারে ঘরে ডেকে এনে, পানি ও শরবত বানিয়ে দিয়ে বলতো, রোজায় এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলে রোজা নষ্ট হয় না। মেজোআপুও এমন বলতো তাই ঝটপট খেয়ে নিতাম! যোহরের আজান হলে, নামাজে ছুটে যেতাম। নামাজ শেষে, বাসায় এসে আপুর সাথে ঘুমিয়ে পড়তাম। ইফতারের পূর্বে মস্তবড় মিসওয়াক নিয়ে দাঁত মাজতাম; তা দেখে ছোটআপু অনেক হাসতো। ভীষণ ঝগড়া বিঁধে দিতাম। বড়আপু ও মা'কে এ নিয়ে নালিশ দিয়ে পৃথক হয়ে যেতাম। মা-বাবা, ভাইয়া ও আপুদের মিলে অনেক বড় ইফতারের আয়োজন হতো আমাদের। আমি সবার আগেই বসে পরতাম ইফতারে। পিয়াজি, বেগুনি, চপ, ছোলাবুট, খোরমা খেজুর, রুহ আফজা শরবতসহ রকমারি বিভিন্ন খাবারে সজ্জিত হতো ইফতারের প্লেট। মা প্রতিটি খাবারই আগে আমাকে দিতেন। শরবতের গ্লাসগুলো আমি আমার সামনেই রাখতাম; তা নিয়ে ছোটআপুর সাথে ভীষণ ঝগড়া হতো। ভাইয়া শেষমেশ আপুকে থামিয়ে আমাকেই দিয়ে দিতো। তখন বড্ড ভালো লাগতো। আমাদের মাসজিদে খতম তারাবীহ্ হতো। বাবা ও ভাইয়ার সাথে তারাবীতে যেতাম। বাবা সর্বদা সামনের কাতারে তারাবীহ্ পড়তেন। আমাকে সাথে নিয়েই সামনের কাতারে যেতেন। প্রথম কয়েকরাকাত বাবার সাথে, বেশ মনোযোগে পড়তাম। ১০/১২ রাকাত পড়ার পর বাবাকে না জানিয়েই, কাতার ভেঙে মসজিদের বারান্দায় চলে আসতাম। পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের আড্ডায় মজে উঠতাম। তারাবীহ্ শেষে -নামাজের গুরুত্ব বোঝাতে বোঝাতে বাবা বাড়িতে নিয়ে আসতেন।

আজ আমি উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছি। ৮টি বছর কেটে যাচ্ছে মা-বাবা, ভাইয়া আর আপুদের সাথে ইফতার করতে পারিনা। ছোটবেলার মতো আজকালের ইফতারের প্লেট এতোটা মজাদার হয় না। শরবতের গ্লাস নিয়ে ঝগড়াও হয় না। তারাবীতে ক্লান্তি লাগে না। সাহরীতেও ঘুম আসে না; তবে মাঝে মাঝে ভীষণ হাসি পায়-অট্টহাসিতে ফেটে পরি, পরক্ষণেই অশ্রুতে ভরে উঠে আখিঁ-  "বড়আপুর চুপিসারে খাবার দেওয়া, যোহরের আজানে মায়ের ইফতার খাওয়ানো, ছোটআপুর সাথে খুনসুঁটি, ইফতারিতে ভাইয়ার বিচার, বাবার সাথে তারাবীতে যাওয়া আর সাহরীতে ডেকে না দিলে সেই অভিমানী দিনগুলো" আবার কি ফিরে পাবো কখনো!

ফুটপাতে শুয়ে থাকা লোকটাও মানুষ। সুতরাং তাকে দেখে নাক ছিটকাবেন না।

স্মৃতিগুলো আজ মনের গহীনে লুকিয়ে আছে...

শৈশবের সেই নির্মল আনন্দ, কৈশোরের দুরন্তপনা, আর তারুণ্যের দুঃসাহসী স্বপ্ন—সব মিলিয়ে এক মায়াবি জগতের মধ্য দিয়ে এসেছি। কত আশা, কত স্বপ্ন, কত অভ...

জনপ্রিয়গুলো দেখুন